মানুষ বেঁচে থাকে তার স্বপ্নের মাঝে। হিমালয় বিজয় কিংবা চন্দ্রাভিযানের ন্যায় দুঃসাহসিক স্বপ্নপূরণের আশার ভেলায় চড়ে নানান চড়াই-উত্রাই পেরিয়ে একজন শিক্ষার্থী প্রবেশ করে উচ্চ শিক্ষায়তনের সবুজ চত্বরে। গ্রাম বা মফস্বলের একজন স্বপ্নবাজ শিক্ষার্থী পেছনে ফেলে আসে অপার মাতৃস্নেহ এবং শৈশব-কৈশোরের একরাশ স্মৃতি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস যখন নিপীড়কের আঁতুড়ঘরে পরিণত হয়, তখন সেই শিক্ষার্থীর সোনালী স্বপ্নগুলো দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়, আর দিকবিদিকশূন্য শিক্ষার্থী প্রমাদ গুনে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের বদলে তাঁর জীবনের নিরাপত্তা শংকা তখন মুখ্য বিবেচনা হয়ে দাঁড়ায়। তেমনি বিগত দেড় দশকের ঘনঘোর আওয়ামী ফ্যাসিবাদের যুগে অন্যসব বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যায় বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় (বুটেক্স) ক্যাম্পাস এবং আবাসিক হলগুলোকে ঘিরে গড়ে উঠেছিলো নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের নির্যাতন ও নিপীড়নের বহু নির্মম উপাখ্যান।
ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকার ক্ষমতা দখলের অব্যবহিত পর থেকেই বিরোধী মত ও দলগুলোর ওপর অব্যাহত দমন নিপীড়ন চালিয়েছিলো, যা সময়ের সাথে ক্রমাগত গুরুতর রূপ পরিগ্রহ করে। এর অংশ হিসেবে দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফ্যাসিবাদী আওয়ামীলীগের ছাত্রসংগঠন, নিষিদ্ধঘোষিত বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, হল ও ক্যাম্পাসগুলোর দখলদারত্ব ও প্রভাব বিস্তারের নগ্ন খেলায় মেতে ওঠে। কেবল বিরুদ্ধ মত ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নয়, সাধারণ শিক্ষার্থীদের স্বাধীন মত ও অধিকারের উপর নেমে আসে নির্মম খড়গ। বুটেক্স ছাত্রলীগের হিংস্রতা ও বর্বরতা ছিলো এই ধারায় নজিরবিহীন সংযোজন।
বুটেক্স ক্যাম্পাসজুড়ে মাদকের ভয়াবহ বিস্তার, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ফান্ডের অর্থ আত্মসাৎ থেকে শুরু করে শিক্ষার্থীদের জোরপূর্বক ছাত্রলীগের প্রোগ্রামে অংশগ্রহণে বাধ্য করা হয়েছিল। কারো মত বা অবস্থান ছাত্রলীগ বা আওয়ামীলীগের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হলে নেমে আসতো নির্মম নির্যাতন। শারীরিক নির্যাতন, মানসিক অত্যাচার এবং একাধিক ক্ষেত্রে গুম করা ও পুলিশে ধরিয়ে দেওয়ার মতো অপরাধের সাথেও বুটেক্স ছাত্রলীগের জড়িত থাকার প্রমাণ রয়েছে। শিক্ষার্থীদের জীবনের নিরাপত্তা, স্বাধীন মত প্রকাশ এবং ক্যাম্পাসে সুস্থ পরিবেশ বজায় রাখার ন্যূনতম অধিকার এই সন্ত্রাসী সংগঠনটি দ্বারা প্রতিনিয়ত লঙ্ঘিত হয়েছে। আবাসিক হলসমূহে গণরুম-গেস্টরুমে র্যাগের নামে নির্যাতন, রাজনৈতিক ভিন্নমতের কন্ঠরোধ, দমন ও পুলিশি নিষ্পেষণের মুখোমুখি করা এবং ক্ষেত্রবিশেষে শিক্ষকদের অবধি নিপীড়নের মুখোমুখি করা হয়েছে।
আমাদের এই ক্ষুদ্র প্রকাশনায় বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুটেক্স) ঘটে যাওয়া সেই সকল নির্যাতনের মর্মস্পর্শী বিবরণ মলাটবদ্ধ করা হয়েছে এবং অভিযুক্ত ছাত্রলীগের নির্যাতকদের পরিচয় ও ভূমিকা স্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে, যেন প্রতিটি নির্যাতনের প্রতিকার ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার দাবী উচ্চকিত হয়। আমাদের প্রত্যাশা রাষ্ট্রীয় প্রশাসন এবং বুটেক্স কর্তৃপক্ষ জড়িত সকল সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে উপযুক্ত আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এইসব সন্ত্রাসীদেরকে বিচার নিশ্চিতের পূর্বে সকল প্রকার পেশাগত কমিউনিটি এবং সাংস্কৃতিক ও সামাজিক অঙ্গনে দলমত নির্বিশেষে বর্জন করা উচিত। পাশাপাশি যেসব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা এ সন্ত্রাসীদেরকে চাকরিতে নিয়োগ দিয়েছে, তাদের কর্তব্য হলো অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে স্ব-স্ব প্রতিষ্ঠানের বিদ্যমান আইনের আলোকে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
বিগত ৫ আগস্ট ২০২৪ খ্রি: তারিখে হাজার শহীদের তাজা রক্তের বিনিময়ে ছাত্র-জনতার এক ঐক্যবদ্ধ গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদী আওয়ামীলীগের পতনের ফলে বাংলাদেশের আপামর জনতার মাঝে বৈষম্যহীন সমাজের এক নূতন প্রত্যাশার সূচনা ঘটে। এই স্বস্তি ও মুক্তির উন্মুক্ত পরিবেশে অতীতের নির্যাতিত শিক্ষার্থীরা তাদের ওপর ঘটে যাওয়া নির্মম নির্যাতনের ভয়ানক অভিজ্ঞতা সোশ্যাল মিডিয়ায় তুলে ধরেন এবং প্রতিটি নির্যাতনের উপযুক্ত প্রতিকার ও সঠিক বিচারের দাবিতে সোচ্চার হন। বৈষম্যহীনতার চেতনায় উজ্জীবিত ছাত্র-জনতার কাছ থেকে নিরঙ্কুশ সমর্থন লাভের মাধ্যেমে এবং বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র ও শিক্ষকদের সমর্থন দ্বারা নির্যাতিত শিক্ষার্থীদের দাবী জোরদার হয়।
অন্যসব ক্যাম্পাসের ন্যায় বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গন হোক সন্ত্রাসমুক্ত, শিক্ষার্থীদের জন্য নিরাপদ এবং জ্ঞানচর্চা ও মুক্ত চিন্তার উদার ক্ষেত্র- যেখানে সবাই সাম্য, মর্যাদা এবং সুবিচার প্রাপ্তির মাধ্যমে দেশ গড়ায় অগ্রণী ভূমিকা রাখার সুযোগ লাভ করে।
পরিশেষে, এই বইয়ের বাক্যগঠন ও বানান সজ্জায় যথাসম্ভব বাংলা একাডেমির প্রমিত বানানরীতি অনুসরণ করা হয়েছে। তবে নির্যাতিত ভুক্তভোগীদের ব্যক্তিগত অনুভূতির স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশভঙ্গিকে অক্ষুণ্ণ রাখতে কিছু বাক্য অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। এতে উল্লিখিত বক্তব্য, তথ্য ও দৃষ্টিভঙ্গি কোন দলমত, শ্রেণীগোষ্ঠী এবং ধর্মবিশ্বাসের প্রতিনিধিত্ব করে না। বইটি কেবলমাত্র অপ্রকাশিত সত্য প্রচারের উদ্দেশ্যে ভুক্তভোগীদের বর্ণিত অনুলিপি হতে সংকলিত। সময় ও ঘটনার প্রেক্ষিতে পাঠকদের নিজ বিবেচনায় বিষয়বস্তু গ্রহণ করার অনুরোধ জানানো হলো।
যদিও সংকলনটি যথাসম্ভব নির্ভুল রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। তথাপি কোথাও অনিচ্ছাকৃত ভুল বা অসঙ্গতি থেকে থাকলে সে বিষয়টি সংশোধনের বিনীত আরজ রইলো। আপনার সুচিন্তিত মতামত ও পরামর্শ সংশোধনের ক্ষেত্রে সহায়ক হবে। অন্যান্য বর্ণনাকারীর অভিজ্ঞতা যাচাইসাপেক্ষে পরবর্তী সংস্করণে সংযুক্ত করা হবে।